বিপ্লব কান্তি দে

প্রেম অবিনশ্বর, মহাসমুদ্রের মাঝখানে খুঁজে পাওয়া একটুকু আশ্রয়,গরমের তীব্র দাবদাহে আকাশ থেকে নেমে আসা এক পসলা বৃষ্টি এবং অফুরন্ত ভালোবাসার সমাহার।আবহমান কাল ধরে মানব মনের গহীনে জন্ম নেয়া ছোট্ট এই শব্দ।ঐটি কেউ প্রকাশ করে নিজের মনের মানুষটিকে,আবার কেউবা আড়াল রেখে সীমাহীন বেদনায় হৃদয়টাকে পুড়াতে থাকে জলন্ত আগুনের ন্যায়।অনেকে মনের মানুষটিকে পেয়ে নিজেকে আনন্দ-উল্লাসে মেতে রাখে,আবার অনেকে হারানোর বেদনায় হারিয়ে যায় অতল সাগরে। পাওয়া না পাওয়ার বেদনায় অনেকে নিজেকে নি:শেষ করে দিয়েছে আগুনের দহনে।

পৃথিবীতে প্রেম ঘটিত অনেক আলোচিত লোমহর্ষ ঘটনা রয়েছে। তার মধ্যে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে চট্রগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সরলা ইউনিয়নের বিখ্যাত সওদাগরের কন্যা মালেকা বানু ও চট্রগ্রামের আনোয়ারার শোলকাটা গ্রামের জমিদার পুত্র মনু মিয়ার বিয়ে।

মহাকবি ফেরদৌসি ইরানের জাতীয় মহাকাব্য ‘শাহনামা’ রচনা করে গেছেন হাজার বছর আগে।যা লিখতে সময় লেগেছিল তেত্রিশ বছর।তিনি লিখে গেছেন সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে ঘটে যাওয়া আর্মেনীয় রাজকুমারী শিরিন,পারসিক রাজা দ্বিতীয় খসরু পারভেজ এবং পাথর খোদাইকর(অনেকে ভাস্কর নামে অভিহিত করেন) ফরহাদের ত্রিভূজ প্রেম কাহিনী।যেটি শিরি-ফরহাদের প্রেম কাহিনী নামে খ্যাত।

ষোল শতকে পারস্য (ইরানের প্রাচীন নাম) লোকগাঁথা কাহিনী আমির পুত্র কয়েস ও বণিক কন্যা লায়লীর প্রেম কাহিনী।লাইলীর প্রেমে পড়ে কয়েস মজনু বা পাগল হয়।যা লাইলী-মজনু প্রেম কাহিনী।

ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহনকারী সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার ইউলিয়াম সেকস্পিয়র’র ষোল শতকের শেষে রচিত ট্রাজেডি রোমিও-জুলিয়েট।ইতালির ভেরোনা শহরের দুই ধনেকুবের মনটেগু পরিবারের সন্তান রোমিও ও ক্যাপিউলেট পরিবারের কন্যা জুলিয়েট।পারিবারিক দ্বন্ধের কারনে প্রেমিক জুটির মৃত্যুবরণ।

বিংশ শতাব্দিতে অর্থাৎ উনিশ শত সালের প্রথম দিকে ভারতের তালসোনাপুর গ্রামের জমিদার পুত্র দেবদাস মুখার্জি ও একই গ্রামের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে পার্বতীর প্রেম কাহিনী।

উল্লেখিত ঘটনাগুলো পৃথিবীতে প্রেম ঘটিত আলোচিত ঘটনা।তবে প্রত্যেকটি বিয়োগান্ত।অর্থাৎ শেষ পরিনিতি তাদের প্রেম কিংবা বিয়ে কোনটিই স্থায়ী হয়নি।এমন একটি প্রেমের ঘটনা কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার ধীরাজ-মাথিনের প্রেম কাহিনী।তাও শত বছরের আগের।এটিও বিয়োগান্ত।

বয়স খুব একটা বেশি ছিল না।হেসে খেলেই শৈশব যেভাবে পার করে সবাই, সেই রকমই বয়স।খোলা চুল বাতাসে উড়িয়ে, বার্মিজ থামি পড়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করা,আবার কখনও পাত কুয়ায়(রিং ওয়েল) গিয়ে দল বেঁধে পানি আনা,কখনও বা বাহারি রংয়ের পোশাক পরে জম্পেশ আড্ডা দিয়ে সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ থানা এলাকার আশেপাশের রাখাইন মেয়েরা সময় পার করত শৈশবের দিনগুলো।

বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকের কথা।দেশের সর্ব দক্ষিণ প্রান্ত টেকনাফ থানায় দারোগার দায়িত্ব নিয়ে আসেন ধীরাজ ।একজন অভিনেতা হিসেবে যেমনি হাঁকডাক ছিল,তেমনি সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর যশও কমতি ছিল না।

শিক্ষক বাবার সন্তান ধীরাজ ভট্রাচার্য্যকে এলোমেলো জীবন থেকে ফিরে আনতেই পুলিশের চাকুরী দেয়া।পরিবার পরিজন থেকে দূরে এসে পুলিশের চাকুরি করা এক দিকে তাঁকে যেমনি নিসংঙ্গতা আকড়ে ধরেছিল, অন্যদিকে দুর্গম জায়গাতে মনও বসছিল না ।তাই অবসর সময়ে টেকনাফ থানার বারান্দায় বসে সময় কাটাত।আর তাঁর বাড়িও কম দূর ছিল না।টেকনাফ থানা ছিল তার দ্বিতীয় কর্মস্থল। আগেরটা ছিল চট্রগ্রাম শহরে।

তখনকার টেকনাফ ছিল অনেকটা দুর্গম এবং ভয়ংকর এলাকা।বাঘ,হাতি থেকে শুরু করে বন্য প্রাণীর কোনটির কমতি ছিল না আশেপাশের বন জঙ্গলে।আর এর ভেতরেই তাঁর পথ চলা।

টেকনাফ থানা এলাকার মধ্যেই ছিল একটি পাত কুয়া।থানা এলাকার আশেপাশের লোকজনের পানি নেওয়ার একমাত্র ভরসা ছিল এটিই।টেকনাফ ছিল তখন রাখাইন অধ্যুষিত এলাকা।সেই কারণে প্রতিনিয়ত রাখাইন যুবতিরা সকাল-বিকাল পানি নিতে আসত এই কুয়ায়। রাখাইন যুবতিরা কখনও হৈহুল্লোড়, কখনও বা মিষ্টি আওয়াজে মাতিয়ে রাখত থানা এলাকা।বিশেষ করে বিকালের সময়টা অলস সময় পার করতো দারোগা ধীরাজ।তাই তিনি থানার বারান্দায় বসে এই সময়টা রাখাইন মেয়েদের পানি নেওয়ার দৃশ্য অবলোকন করতেন।আর রাখাইন যুবতিরাও কম জানত না।তারাও বাহারি রংয়ের পোষাক পরে নিত্য দিন আসা যাওয়া করত থানা এলাকায়।

রাখাইন যুবতিদের বড় একটা দল ছিল।তারা এক সাথে পানি নেয়ার জন্য আসত পাত কুয়ায়। তাদের মধ্যে ছিল রাখাইন যুবতি মাথিন।আর মাথিন ছিল স্থানীয় রাখাইন জমিদার ওয়ান থিনের একমাত্র রূপবতী কন্যা।যখন তারা দল বেঁধে পানি নিতে আসত বিকাল বেলা,সে সময় ধীরাজ ভট্রাচার্য্য বসে থাকত থানার বারান্দায়।কখনও রাখাইন যুবতিরা চেয়ারে বসে থাকা মানুষটির দিকে তাকাতো, আবার কখনও দারোগার চোখের দৃষ্টি যেত যুবতিদের দিকে।এভাবেই কেটে যায় কিছু দিন,কিছু মাস।আর এরই মধ্যে ভাল লাগার শব্দটি জন্ম নেয় মাথিন আর দারোগার হৃদয়ের গহিনে ।দিন যায়,মাস যায়, গাঢ় হতে থাকে তাদের ভালোবাসা।সব কিছু যখন আপন গতিতেই চলছিল, তার মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়াল বাবার কাছ থেকে আসা একটি মাত্র টেলিগ্রাম।যেখানে লেখা ছিল তোমাকে দ্রুত কলকাতায় যেতে হবে।হয়তো ছুটি,নতুবা চাকুরী ইস্তফা দিয়ে।ধীরাজ আর কালক্ষেপণ না করে এক সন্ধ্যায় পাড়ি জমালেন নিজ বাড়িতে।আর এদিকে প্রেমে বেসামাল মাথিন অস্থির জীবন কাটাতে লাগলেন।কারণ দারোগা ধীরাজ যাওয়ার সময় তাকে যে বলে যায়নি ।প্রেমিক হারানোর তীব্র শোকে মাথিন অনিদ্রা অনাহারে দিন কাটাতে থাকে।আর দিন গুনতে থাকে তার প্রিয় মানুষটি ফিরে আসার।কিন্তু কে জানতো এইটি যে ছিল ধীরাজের অগস্ত্যযাত্রা ? অবশেষে দীর্ঘ দিন অপেক্ষার পর ধীরাজ ফিরে না আসায় সীমাহীন বেধনায় প্রেমিকের শোকে অনাহারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মাথিন।পরিসমাপ্তি ঘটে একটি অধ্যায়ের।সেই থেকে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানা এলাকার পাত কুয়াটির নাম রাখা হয় মাথিনের কূপ।এই কুয়াটি সংরক্ষণ করা হয়েছে টেকনাফ থানা এলাকার ভিতরেই।এখনো ফি বছর ধীরাজ-মাথিন স্মৃতি বিজড়িত এই কুয়াটি দেখতে যায় হাজার হাজার পর্যটক।

ধীরাজ ভট্টাচার্য্য’র ব্যক্তিগত জীবনী নিয়ে লেখা ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ লাহোরের ওবাইদুল্লাহ রোডের জিলানী ইউনিক প্রেস থেকে ১৯৩০ সালের ১ আষাঢ় বইটি প্রকাশিত হয়। যেখানে তিনি লিখে যান ধীরাজ-মাথিনের ভালোবাসার কাহিনী ।

পুনশ্চ: তবে অনেক রাখাইন ধীরাজ ভট্রাচার্য্য’র এই লেখা মানতে নারাজ।তাদের মতে, এটি কল্পিত চরিত্রের ইতিহাস মাত্র।

লেখক:সম্পাদক,দৈনিক কক্সবাজার প্রতিদিন।